
আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,
তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে তাঁর ইহরাম বাধাঁর পূর্বে এবং কুরবানীর দিন বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফের পূর্বে কস্তুরী মিশ্রিত সুগন্ধি মেখে দিতাম।
হে আবু হুরায়রা রাঃ! তুমি খুশবু ব্যাবহার করবে; এতে আল্লাহতা’য়ালার ফেরেস্তা তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে!
(আল-হাদিস)
আগর কাঠ এবং আগর তেল সংক্রান্ত বিষয়ে:
মুসলিমবিশ্বে আগরকে বিবেচনা করা হয় মানবজাতিকে দেয়া ধরিত্রীর অনন্য উপহার হিসেবে। ইসলাম ধর্মে এটি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন উৎসব উদযাপন ও প্রার্থনায়। পবিত্র কা’বা ঘরের পরিচর্যা রীতির এক অপরিহার্য উপাদান এই – ‘ওউদ’। “হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সুনির্দিষ্টভাবে আগরকে উল্লেখ করেছেন উৎকৃষ্ট সুগন্ধি ও বিভিন্ন রোগের প্রতিকারক হিসেবে। এছাড়াও হাদিসে বর্ণিত আছে, জান্নাতবাসীগণ সেখানে যে সুগন্ধি কাঠ প্রজ্বলন করবেন তা এই – আগরকাঠ।” তাই মুসলিমদের কাছে রয়েছে এর বিশেষ কদর।
আগরের সুগন্ধি প্রশান্তিদায়ক এবং শরীরের শক্তি বৃদ্ধিকারী বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন। মালয় ও চাইনিজদের আদি চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নিরাময়ের ঔষধ প্রস্তুতির গুরূত্বপূর্ন উপাদান হিসাবে আগর কাঠ ব্যবহার হয়ে আসছে। অ্যারোমাথেরাপিতেও এর ব্যবহার আছে। এছাড়া মূত্রবর্ধক, কামোদ্দীপক, কোষ্ঠ্য পরিষ্কারক হিসাবে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন ত্বকের রোগ, ব্রংকাইটিস, হাঁপানী ও বাত রোগে এর ব্যবহার হয়ে থাকে। আগর উড থেকে আহরিত তেল বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধি। এই সুগন্ধির বিশেষ বৈশিষ্ট হলো এটি একটি এ্যলকোহলমুক্ত সুগন্ধি। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনে এ সুগন্ধির আকাশ ছোঁয়া চাহিদা বিশ্বজুড়ে। আগর উড থেকে তৈরি কাঠের টুকরা বা আগর তেল বা আগর আতর উভয়ই সুগন্ধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আগর তেল ছাড়া কাঠ বা পাউডারজাত সামগ্রী থেকে ধূপের ন্যায় প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আগরের সুবাস নেয়া হয়। আগর উডের নির্যাশ সুগন্ধি সাবান, স্যাম্পুসহ অন্যান্য প্রসাধণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
আগরকাঠ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন–আগরউড, ওউদ , অ্যালোসউড, ঈগলউড, গাহারু, জিনকো ইত্যাদি। এটি মূলত অ্যাকিলারিয়া (Aquilaria) নামক গাছ থেকে প্রাপ্ত সুগন্ধযুক্ত ও অত্যন্ত মূল্যবান হার্ডউড। গাছটি সমতল অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না এবং কান্ড, ডাল-পালাও সরাসরি সুগন্ধি নয়। বিচিত্র এক প্রক্রিয়ায় গাছের সাধারন কাঠটি হয়ে উঠতে থাকে মহামুল্যবান আগর। মূলত গাছটির কান্ডের ভিতর, অভ্যন্তরীণ আঘাত বা সংক্রমণের কারণে তৈরি হতে থাকে রজন (Resin)। কিন্তু আধুনিককালে প্রক্রিয়াটিকে তড়ান্বিত করতে, কৃত্রিমভাবে পরিণত গাছগুলোর দেহে ছিদ্র করে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় বিশেষ এক প্রকারের অণূজীব যা গাছের ঐ অংশকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ও এক পর্যায়ে শুকিয়ে ফেলে। তারপর শুকিয়ে যাওয়া সে অংশগুলো (রেজিন ও কাঠ) সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে তৈরি হয় মহার্ঘ্য আতর ও গন্ধস্বার তেল (Essential oil)।
আরবীয় ব-দ্বীপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আগরের সম্মান ও সমাদর কল্পনাতীত। এর হালকা ঝাঁঝালো ও সমৃদ্ধ কাঠময় ঘ্রাণ বিত্ত, মর্যাদা ও আরবীয় সংস্কৃতির প্রতীক। আরবের স্থানীয় সুগন্ধির দোকানগুলোর বাইরে সুদৃশ্য জ্বলন্ত বার্নার থকে ছড়াতে থাকা- সুবাসিত ‘বাখুর'(Incense) মনে জাগিয়ে তোলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগময় অনুভুতিকেও। মসজিদ থেকে শুরু করে বসত বাড়িসহ আরবের সর্বত্রই আগরের জয়জয়কার। খলিফা হারুণ-অর-রশীদের সময়ে রচিত ‘আরব্য রজনী’র গল্পগুলোতে বহুবার উঠে এসেছে আগরের কথা- কখনও সুগন্ধি আতর, বাখুর, প্রার্থনা রীতি বা শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে; কখনও ধন-দৌলত ও বাণিজ্যের সম্পর্কে; কখনওবা প্রবেশদ্বার ও রাজার প্রিয় পাখিটির খাঁচা বানানো প্রসঙ্গে। আরবীয় ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই আগর।
সুগন্ধির ব্যবহার কোন অঞ্চলের মানুষ প্রথম শিখেছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে মিশরকে বলা হয় সুবাস সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর। সেসময় মিশরীয় সুগন্ধিশিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান যেমন- ধূপগাছ, কাঠ, রজন, ফুল, জাফরান ও বিভিন্ন লতাগুল্মের মাঝে আগরকাঠ ছিল অন্যতম প্রধান। গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডটাসের বর্ণনায় পাওয়া যায়, পিরামিডীয় যুগেও এর ব্যবহার ছিল প্রভাবশালী ফারাওদের মৃতদেহ সংরক্ষনে। মিশরীয়রা “বাখুর” বা ধূপদানের পদ্ধতি আবিষ্কার না করলেও প্রাথমিক নথিপত্রগুলোয় তদের ব্যবহারের কথা লিপিবদ্ধ পাওয়া যায় যা দেখে গ্রীস, রোমসহ আরো বিভিন্ন দেশে এর প্রচলন হয়।
১৬০০ শতাব্দীতে ভারতের মূঘল শাসনামলে ধূপ ও সুগন্ধি ছিল প্রাত্যহিক রাজকীয় জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। প্রাচীন ও সমসাময়িক প্রণালীর উপর ভিত্তি করে সেসময় বর্ণিত হয়েছে ১২টি অভিজাত সুগন্ধির প্রস্তুত প্রণালী, যার মধ্যে ১১টিতেই ছিল আগর বা আগর থেকে তৈরি মুল্যবান গন্ধস্বার তেল।
আগরের মনোমুগ্ধকর অরণ্যময় সুগন্ধ ও দুষ্প্রাপ্যতা তাকে দিয়েছে এক অনন্য ও রহস্যময় স্থিতি। বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য ধারার বড় বড় প্রস্তুতকারকেরা এর সাথে কৃত্রিম উপকরণ মিশিয়ে বিভিন্ন আধুনিক পারফিউম তৈরি করলেও, সুগন্ধিপ্রেমীদের কাছে কন্নৌজের কারিগরদের মত মাটির ডিস্টিলারিতে প্রস্তুত বিশুদ্ধ আগরের – ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধির কদর যেন বেশিই।
কালের আবর্তে প্রাচীন সংস্কৃতির অনেককিছু হারিয়ে গেলেও হারায়নি – আগর কাঠ; বরং যুগ যুগ ধরে বেড়েই চলেছে এর আবেদন। আর সকল গুনের পাশাপাশি নর-নারীর মনে প্রশান্তি ও আদিম অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তুলতে এর মোহময় সুবাসের জুড়ি মেলা ভার। নিঃসন্দেহে আগর স্থান, কালের সীমারেখা ছাড়িয়ে; সমগ্র মানবজাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে ছড়িয়ে দিয়েছে তার মুগ্ধতা।
ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের সময় থেকে যুগ যুগ ধরে এ কাঠ ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে উৎপাদিত হয়ে ছড়িয়ে পরে বিশ্বময়। ধারণা করা হয় আরবীয় উপকূল, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান – দেশগুলিতে “দ্য উড অফ দ্য গডস” এর রয়েছে কমপক্ষে ৩০০০ হাজার বছরের ইতিহাস।
বহু শতাধিক উদ্ভিদ প্রজাতি সুগন্ধিদ্রব্য তৈরি করলেও আগর তারমধ্যে অনন্য। শুধুমাত্র প্রসাধনী সুগন্ধি, তেল বা সাবান নয়, যুগে যুগে এর নানান ব্যবহারের মধ্যে আগর প্রচলিত ছিল –আয়ুর্বেদিক ও সমসাময়িক চিকিৎশাস্ত্রে, রন্ধনশিল্পে – পাতা থেকে চা প্রস্তুত, পান (Betel leaf) ও বিভিন্ন সুগন্ধময় খাবারের মশলা হিসেবে।
For more information regarding Agarwood usage visit : https://lotuszenincense.co.uk/blogs/incense/a-beginners-guide-to-burning-agarwood-chips